Sunday, 23 October 2016

গ্রন্থ সমালোচনা


আলালের ঘরের দুলাল
লেখক: প্যারিচাঁদ মিত্র (১৮১৪-১৮৮৩)
প্রথম প্রকাশ: ১৮৫৮
প্রকাশক: অ্যাডন পাবলিকেশন
মূল্য: ২৩০ টাকা
পৃষ্ঠা: ১৫১
উনিশ শতকে শুরুর দিকে যখন বাংলা সাহিত্যের গদ্য রীতি ততটা পরিপূর্ণতা লাভ করেনি সে সময়ে সাহিত্য রচনার গতানুগতিক ধারা থেকে বের হয়ে সর্বজনবোধগম্য ভাষায় প্যারিচাঁদ মিত্র রচনা করেন তার প্রথম উপন্যাস ‘আলালের ঘরের দুলাল’। এটি একই সাথে বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস।
‘আলালের ঘরের দুলাল’ উপন্যাসটি প্রথমে ১৮৫৪ সালে মাসিক পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। ১৮৫৮ সালে তা গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে তা ‘দ্যা স্পয়ল্ট চাইল্ড’ নামে ইংরেজিতে অনূদিত হয়। অনেক সাহিত্য সমালোচকগন একে ‘বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সামাজিক নকশা’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। গ্রন্থটি সম্পূর্ণ সামাজিক পটভূমিকায় রচিত। সে সময়ের কলকাতার নব্যশিক্ষিত ‘ইয়ংবেঙ্গল’দের বিপথগামী হওয়া এবং তার পরিণতি এই উপন্যাসের মূল উপজীব্য বিষয়। এতে তিনি সে সময়ের সমাজব্যবস্থার নানা অসঙ্গতি, যেমন; সামাজিক বিশৃঙ্খলা, পাশ্চাত্য শিক্ষার অন্ধ অনুকরন, বিশেষ করে নব্যশিক্ষিতদের নৈতিক অধো:পতন ইত্যাদি সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। আর এর পেছনে কারণ হিসেবে ধর্ম চর্চা ও নৈতিক শিক্ষার অভাবকে তিনি দেখিয়েছেন। তিনি এই উপন্যাসে কিভাবে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা এ সমস্যা থেকে উত্তরণ ঘটাতে পারে তা সুনিপুনভাবে তুলে ধরতে চেষ্টা করেছেন।
উপন্যাসে দেখা যায় যে, বাবুরাম বাবু তার অতি আদরের পুত্র মতিলালকে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা দেয়ার ব্যাপারে উদাসীন ছিল। অধিকন্তু মতিলাল নানা কুসঙ্গে পড়ে অধো:পতনের শেষ ধাপে চলে যায়। অপর দিকে তার অনূজ রামলাল বেড়ে বড় হয় বরদাবাবুর সংস্পর্শে থেকে এবং নীতিবান বরদাবাবুর নিকট থেকে সে ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা পায়। ফলে সে সবার প্রশংসা লাভ করে। উপন্যাসের কয়েকটি চরিত্র যেমন, নীতিবান বরদাবাবু, আদর্শ যুবক রামলাল, সজ্জন বেনীবাব এই চরিত্রগুলো তেমন একটা ফুটে উঠেনি। তবে পথভ্রষ্ট চরিত্র মতিলাল এবং তার সঙ্গী হলধর, গদাধর চরিত্রগুলো উপন্যাসটিকে সাফল্য দিয়েছে। তাছাড়া আরও কয়েকটি চরিত্র যেমন, ধুর্ত উকিল বটলর, ধড়িবাজ বাঞ্চারাম, তোষামোদকারী বক্রেশ্বরবাবু এগুলোকে খুব জীবন্তভাবে তিনি ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। আরেকটি জীবন্ত চরিত্র ছিল ঠকচাচা বা মোকাজান মিঞা।
উপন্যাসের কাহিনী নির্মাণে ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও সমাজের বিভিন্ন খন্ডচিত্রগুলো নিপুন দক্ষতার সাথে অঙ্কিত হয়েছে। এছাড়া সে সময়ের সংস্কৃত ও ইংরেজিঘেষা রচনারীতির ধারা থেকে বের হয়ে এসে প্রথম চলিতরীতিতে সাহিত্য রচনা প্রশংসার দাবী রাখে। তার এ সাহিত্য রীতি ‘আলালী রীতি’ নামে পরিচিত। তার স্বকীয় সত্ত্বায় ভাস্বর এই সাহিত্যকর্মে তিনি যে শিল্পনৈপুন্য ও রচনাশৈলী প্রদর্শন করেছেন তা পরবর্তীতে আধুনিক উপন্যাসের পথকে মসৃণ করেছে।
সার্বিক বিচারে এটিকে উপন্যাস হিসেবে আখ্যা দেয়া যায় কিনা তা নিয়ে বিতর্ক আছে। অনেক সমালোচকের মতে এটি উপন্যাস নয়, বরং উপন্যাসের লক্ষণাক্রান্ত। পরিশেষে বলা যায় যে, সার্থক উপন্যাস না হলেও পরবর্তীতে বংঙ্কিমচন্দ্রের হাত ধরে যে উপন্যাসের স্বাদ পেয়েছি তার পেছনে ‘আলালের ঘরের দুলাল’ উপন্যাসের অবদান অনস্বীকার্য। আর এখানেই প্যারিচাঁদ মিত্রের সার্থকতা।

No comments:

Post a Comment